অনেক ক্ষেত্রে প্রসূতি নারীরা না বুঝেই বিপদ এড়াতে সিজারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অহেতুক সিজার এড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর নজরদারি ও তদারকি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও প্রসূতি ও তার স্বজনদের সদিচ্ছা থাকা দরকার বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৫ শতাংশ সিজার স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু খুলনায় সরকারি হাসপাতালে এই হার যতটা বেশি তার চেয়ে অনেক বেশি বেসরকারি ক্লিনিকে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ব্যবসায়িক মানসিকতা বেশি কাজ করছে।
খুলনা সদর হাসপাতালে ২০১৮ সালে ৭২৭ জন প্রসূতি নারী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জন নারী মৃত শিশু জন্ম দিয়েছেন। বাকী ৭১৭ জন নারীর মধ্যে স্বাভাবিক প্রসব (নরমাল ডেলিভারি) হয়েছে ৪১৪ জনের আর ৩১৩ জনের অস্ত্রোপচার (সিজারিয়ান ডেলিভারি) হয়েছে।
অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ৪৩.৬৫ শতাংশ। কিন্তু বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে এই হার আরও অনেক বেশি।
খুলনা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে বিভিন্ন উপজেলা ও শহরের দুটি ক্লিনিকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানের গত জুন মাসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ৩৬২ জন প্রসূতি নারী নতুন বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৮০ জন নারী স্বাভাবিকভাবে শিশু জন্ম দিয়েছেন। আর ২৮২ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি ক্লিনিকে সিজারিয়ান বাচ্চা প্রসবের হার ৭৭.৯০ শতাংশ।
এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি বিভিন্ন ক্লিনিকের রেজিস্ট্রারে সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে না। নরমাল ডেলিভারি না হলেও তারা রেজিস্ট্রারে ঠিকই কম বেশি দেখিয়ে দায়সারা হিসেব রাখেন। আর এ গোঁজামিল তথ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেখিয়ে থাকেন।
এ ব্যাপারে গাইনি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. রওশন আরা বলেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু কারণে সাধারণত প্রসূতি মায়ের অস্ত্রোপচার দরকার হয়। পেটে বাচ্চার অবস্থান যদি খারাপভাবে থাকে, প্রসবের নির্ধারিত সময় পার হলে অথবা মায়ের জরায়ুর রাস্তায় যদি বাচ্চা চলে আসে।’
তবে অহরহ কেন সিজার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের জন্য প্রসূতিকে ১৬-২০ ঘণ্টা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার। চিকিৎসকরা সাধারণত এই সময়টা রোগীকে দিতে চান না। আবার বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর ব্যবসায়িক মনোভাব কাজ করে। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে প্রসূতির স্বজনরা যেকোনো ঝামেলা এড়াতে সিজার করাতে চান।’
খুলনায় বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে সিজারের শতকরা হার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে সিজারের হার অনেকটা বেড়েছে। ইংল্যান্ডে এখন প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ সিজার হয়। কিন্তু খুলনায় অনেক বেশি হারে সিজার হয় যা প্রসূতি নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর বেসরকারি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি হয় না বললেই চলে।’
গাইনি চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথমবার সন্তান প্রসবের জন্য সিজার করা হলে পরবর্তী সন্তান প্রসবের জন্যও সিজার দরকার হয়। সিজারের ফলে একজন গর্ভবতী মায়ের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে ৪টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সিজার করার সাথে সাথে এর ঝুঁকি বাড়তে থাকে। প্রতিবার সিজার করার পর যে ক্ষত তৈরি হয় তা মায়ের ব্লাডারকে জরায়ুর সাথে আটকে দিতে পারে। এর ফলে সিজার করার সময় তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
সিজারিয়ানের একটি সাধারণ ঝুঁকি রক্ত জমাট বাঁধা। মাতৃমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ এটি। সিজারিয়ান মায়েদের ক্ষেত্রে সাধারণত পায়ে এবং পেলভিক এরিয়াতে রক্ত জমাট বাঁধে। এই জমাট বাঁধা রক্ত ভেঙে যেতে পারে এবং লান্সে পৌঁছে যেতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধার কারণে পা ফুলে যেতে পারে এবং ব্যথা হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ ধরে অপারেশন ও বেড রেস্টে থাকার ফলে রক্ত জমাট বাধার ক্ষেত্র তৈরি হয়। যদি এটি তাড়াতাড়ি নির্ণয় করা যায় তবে এর চিকিৎসা সম্ভব। একের অধিক সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে সার্জারির সময় এবং রিকভারির সময়, দুটোই দীর্ঘায়িত হয় তাই এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সঠিক সময়ে এটি ধরতে না পারলে সিজারিয়ানের মৃত্যু ঘটতে পারে।
সিজারিয়ানের কারণে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া, প্লাসেন্টা অ্যাক্রিটা এবং প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’র সমস্যাগুলো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সিজারের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে এসব সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে। হিস্টারেক্টমি বা পুরো ও আংশিক জরায়ু কেটে ফেলার ঝুঁকি সিজারের সংখ্যার সাথে সাথে বাড়তে থাকে।
নগরীর একাধিক বেসরকারি ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রসূতি নারীর সিজার হলেও তা নিয়ে কোনো তদারকি বা নজরদারি নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। অহেতুক সিজার রোধে কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ক্লিনিকগুলোতে হরহামেশাই চলছে সিজার ব্যবসা। ক্লিনিকগুলোর ব্যবসায়িক মানসিকতায় সিজার করাতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।
সম্প্রতি নগরীর শাপলা ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া প্রসূতি আছিয়া খাতুনের স্বামী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রথম সন্তান ভেবেছিলাম নরমাল ডেলিভারি করানো সম্ভব হবে। কেননা আমার স্ত্রীর কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু ডাক্তার আমাদের বললেন, ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তাই সিজার করাতে হয়েছে।’
সিজারিয়ান কয়েকজন মায়ের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিজারের পরবর্তী সময়ে তাদের ভুগতে হয়েছে। অনেকেরই সেলাই করা স্থানে এখনও ব্যথা রয়েছে। কেউ কেউ দীর্ঘ সময় ধরে মাজায় ব্যথা অনুভব করেন। ভারি কাজ করতে পারেন না। ফলে তাদের একাধিকবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. গৌতম কুমার মণ্ডল বলেন, সিজার রোধে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সকলকে সিজারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রসূতির যেমন ব্যথা সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে তেমনি প্রসূতির স্বজনদেরও আগ্রহ থাকতে হবে। এছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগ কঠোর নজরদারির পাশাপাশি চিকিৎসকদের নরমাল ডেলিভারির জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে।
খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. সৈয়দ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ১৫-২০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে সিজারের জন্য আমাদের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক বেশি সিজার হয়ে থাকে। অহেতুক সিজার রোধে আমাদের নজরদারি রয়েছে। তবে তা ফলপ্রসূ নয়। এজন্য আমাদের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। ‘কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সিজার রোধে প্রসূতি ও চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করতে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করব। তারপরও যেসকল ক্লিনিকে সিজারের প্রবণতা বেশি বলে মনে হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
খুলনা সিভিল সার্জন এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, জরুরি প্রয়োজন ছাড়াই বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ব্যবসায়িক মানসিকতার কারণে সিজার বেশি হচ্ছে। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের সিজার করানোর প্রবণতা থাকে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে নরমাল ডেলিভারি যাতে হয় সেজন্য নির্দেশনা দেয়া আছে। বেসরকারি ক্লিনিকের ক্ষেত্রে আমরা নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেব।